মানুষের ক্ষেত্রে যেমন বলা হয় পানির আর এক নাম জীবন, গাছ পালার ক্ষেত্রেও বচনটি সমান ভাবে প্রযোজ্য । গাছ শিকড়ের সাহায্য মাটিতে সংরক্ষিত প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে। গাছ কঠিন কোন খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করতে পারে না। পানির সাহায্যে প্রয়োজনীয় খাদ্য গুলিয়ে তরল অবস্থায় গ্রহণ করে । পানির সাহায্যে গাছ সমস্ত খাদ্য বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পাঠাতে সক্ষম হয়। পানির অভাব থাকলে গাছ খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করতে পারে না । গাছকে তখন উপবাস থাকতে হয়। পানির অভাব গাছ বাড়তে পারে না। আবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানিও গাছের জন্য ক্ষতিকর । মাটিও অতিরিক্ত পানি ধরে রাখতে পারে না। অতিবৃষ্টির সময় অতিরিক্ত পানি মাটির উপর দিয়ে গড়িয়ে নদীনালায় খাবার সময় গাছের অনেক খাদ্য গলিয়ে ধুয়ে নিয়ে যায়। মানুষ যেমন পানিতে ডুবে শ্বাস বন্ধ হয়ে অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় । গাছের শেকড়ও তেমনি ভাবে পানিতে ডুবে শ্বাস বন্ধ হয়ে অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় । মাটিতে রসের অভাব হলে খরা মৌসুমে গাছে পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে । গাছের প্রকার ভেদে পানির চাহিদা সমান নয় । তাই কোন ধরনের গাছ কত দিন পর কি পরিমাণ সেচ দিতে হবে তা অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। পক্ষান্তরে বর্ষাকালে কোন অবস্থায় যেন গাছের গোড়ায়, বেড়ে, টবে/পলিব্যাগে সংরক্ষিত চারার গোড়ায় পানি জমে না থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে । সুতরাং পানির অভাব হলে গাছে পরিমাণ মতো পানি দেওয়া আর অতিরিক্ত পানি থাকলে মাটি থেকে তা সরিয়ে দেওয়া একান্ত প্রয়োজন । সেচ হলো পানির অভাব হলে গাছে কৃত্রিম উপায়ে পানি সরবরাহ করে চাহিদা পূরণ করা । আর নিষ্কাশন হলে অতিরিক্ত পানি সরিয়ে দিয়ে গাছের জন্য উত্তম পরিবেশ সৃষ্টি করা। গাছের জন্য উভয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
ফল গাছে পানি সেচের গুরুত্ব
কৃষি কাজের জন্য অন্যতম এবং অপরিহার্য উপাদান হল পানি। বাংলাদেশের শস্য (ফলসহ ) উৎপাদন মৌসুমী জলবায়ু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । শীতকালে এদেশে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে । ফসলের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য মৃত্তিকাস্থ উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানসমূহ অপরিহার্য । পানি মৃত্তিকাস্থ খাদ্যোপাদানসমূহকে দ্রবীভূত করে গাছের বিভিন্ন অঙ্গে সঞ্চালন, অংগার আত্মীকরণ, শস্যের সজীবতা সংরক্ষণ, প্রয়োজনীয় হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন সরবরাহ প্রভৃতি কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাটিতে পর্যাপ্ত রসের অভাব হলে গাছের বৃদ্ধি ব্যহত হয় । বাংলাদেশে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত অধিক হলেও এটি বার মাস সমভাবে বিস্তৃত নয় । উদ্ভিদের জন্য পানি একটি অত্যাবশীকীয় উপাদান। যখনই পানির অভাব ঘটে তখনই ঘটে অত্যাবশ্যকীয় উদ্ভিদে নানারূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং দীর্ঘ সময় পানির অভাব হলে গাছ মারা যেতে পারে। মাটিতে যখন গাছের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সহজলভ্য অবস্থায় থাকে না, তখন কৃত্রিম উপায়ে পানি সরবরাহ করাকেই সেচ বলে । গাছে কখন কিভাবে কতটুকু সেচ দিতে হবে তা ঐ গাছের বিভিন্ন অবস্থা, আবহাওয়া ও মাটির উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মত একটি অতি জনবহুল দেশের সীমিত জমিতে উৎপাদ বৃদ্ধির জন্য একর প্রতি ফলন এবং ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি অপরিহার্য । আবার উচ্চ ফলনশীল আধুনিক উন্নত জাতের ফসল চাষাবাদ সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া সম্ভব নয় । তাছাড়া অনাবৃষ্টি, অল্পবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টিপাত ইত্যাদি কারণে ফসলের ক্ষতি এড়াতে হলে সেচ ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই । শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ করতে হলে তা হবে সম্পূর্ণ সেচ নির্ভর । এমনকি বর্ষা মৌসুমেও সাময়িক অনাবৃষ্টি এড়িয়ে সর্বোচ্চ ফলন নিশ্চিত করতে হলেও সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে । এসব কারণে বাংলাদেশে সেচের গুরুত্ব অপরিসীম।
ফল গাছের পানি নিষ্কাশনের গুরুত্ব
ফসলের জমিতে বা ফলের বাগানে পানি সেচ দেয়া যেমন দরকার তেমনি অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাকরণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । কোন কোন ফলদ গাছে যেমন-পেঁপে, আনারস, কাঁঠাল, তরমুজ, কলা ইত্যাদি পানির প্রতি বেশি সংবেদশীল অর্থাৎ এসব গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে গাছের খুব ক্ষতি হয় । এমনকি গাছ মারা যেতে পারে। তাই কাঁঠাল বাগানে কোন গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে তা সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। সুন্দর ভাবে পানি নিষকাশনের জন্য বাগানের চারদিকে নিকাশন নালা থাকা আবশ্যক যে সেচের অতিরিক্ত পানি বা অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে অতিরিক্ত পানি অনায়সে বের হয়ে যেতে হয় । ফসলের সর্বাধিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে শিকড়ের পরিবেশকে প্রয়োজনীয় সরস অবস্থায় রাখাই নিষ্কাশনের প্রধান উদ্দেশ্য । এছাড়া ফসলের জমি থেকে অতিরিক্ত পানি অপসারন করা হলে গাছের শিকড়ের সহজ বৃদ্ধি, ক্ষতিকর দ্রব্য হ্রাস, আহরণযোগ্য নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি, সময়মত চাষাবাদ ও উপকারী অনুজীবের কার্যকারিতা ইত্যাদি বৃদ্ধি পায় ।
ফল গাছে পানি সেচের সময় ও পানির পরিমাণ
জমিতে বা ফলের বাগানে কখন সেচ দিতে হবে এবং কী পরিমাণ সেচ দিতে হবে এ দুটি প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ সেচের পানি প্রদানের লক্ষে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে
উলেখিত বিষয়গুলো বিবেচনার জন্য মৃত্তিকা, উদ্ভিদ, আবহাওয়া, সেচের পানির উৎস ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত উপাত্ত ও তথ্যাদির প্রয়োজন ।
মৃত্তিকার যে সব তথ্যাদি বিশেষ ভাবে জানা ও বিশেষণ আবশ্যক সেগুলো হচ্ছে মাটির বুনট, গভীরতা, সংযুক্তি, লবণাক্ততা বা ক্ষারত্ব, বায়বীয়তা, নিষ্কাশন, অনুপ্রবেশ, অনুস্রবণ, চুয়ানো, ভূ-গর্ভস্থ পানি তলের গভীরতা এবং পানি ধারন ক্ষমতা ইত্যাদি ।
উদ্ভিদ সম্পর্কিত জরুরি তথ্যাদি হচ্ছে ফসলের প্রকার, শেকড়ের বৈশিষ্ট্য, বর্ধনের সময়ে বিভিন্ন ধাপে পানির ব্যবহার, মৃত্তিকায় পানি স্বল্পতার কারণে উদ্ভিদের যে ধাপ সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইত্যাদি ।
আবহাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে চাষাবাদের ঐতিহ্যগত পদ্ধতি বীজ বপন অথবা চারা রোপণের তারিখ, গাছের ঘনত্ব, সারির দূরত্ব, সার ব্যবহার, আগাছা অথবা পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ।
উদ্ভিদের ক্ষরা সহনীয়তা বলতে বোঝায় মৃত্তিকাস্থ শিকড় অঞ্চলে যে পরিমাণ সঞ্চিত পানি (%) গাছ ব্যবহার করলে গাছের বিশেষ কোন ক্ষতি হয় না। অধিকাংশ ফসলের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, গাছ মৃত্তিকায় সঞ্চিত পানির ৫০% ব্যবহার করার পরে যদি সেচ দেয়া হয় তা হলে ফসল উৎপাদনের মাত্রা কমে যায় না । এ ক্ষেত্রে সেচ কে বলা হয় মৃত্তিকাস্থ প্রাপ্য পানির ৫০% কমতিতে সেচ প্রদান । কোন কোন ফসলের ক্ষেত্রে ৭৫% পানি কমতিতে ও ফসলের উৎপাদনের ক্ষতি হয় না। তবে ৫০% মাত্রাকেই সাধারন সেচের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে । তিনটি প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে সেচের সময় ও পরিমাণ নির্বাচন করা যায় যথা-
ক) মৃত্তিকা সম্পর্কিত খ) উদ্ভিদ সম্পর্কিত গ) আবহাওয়া সম্পর্কিত
ক) মৃত্তিকা সম্পর্কিত:
পদ্ধিতে প্রধানত মাটিতে পানির প্রাপ্যতা মাপা হয় । জমি থেকে মাটির নমুনা সগ্রহের সময় মনে রাখতে হবে যেন এই নমুনা যে জমি থেকে মাটি নেয়া হবে মোটামুটি ভাবে সেই জমির মাটির প্রতিনিধিত্বমূলক হয় । এক্ষেত্রে অনুভব পদ্ধতি এবং অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মাটিতে পানির প্রাপ্যতা নির্ধারন করা যায় ৷
১ । অনুভব পদ্ধতি (Feel method) - এ পদ্ধতিতে মৃত্তিকার অবস্থা দেখে এবং স্পর্শ করে মৃত্তিকার পানির পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা করা হয় । মৃত্তিকার পানি ধারণ বা রসের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য ফসল ভেদে ৩০-১০০ সে:মি: নিচ থেকে অথবা সংশিষ্ট ফসলের শিকড়ের গভীরতার ৬০-৭০% নিচ থেকে মাটি খুঁড়ে মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয় । সংগৃহীত নমুনা থেকে এক মুঠো মাটি হাতের মুঠিতে চেপে বল বানানো হয় এবং স্পর্শের অনুভূতি ও অবস্থা সারণি-১ প্রদত্ত অবস্থার সাথে তুলনা করে পানি সেচের উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা যায় ।
হাতের সাহায্যে মৃত্তিকার পানি পরিমান পদ্ধতি ও সেচের সময় নির্ধারণ
সারণি-১
খ) উদ্ভিদ সম্পর্কিত পদ্ধতি
উদ্ভিদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেও সেচের প্রয়োজনীয়তা যায়। যখন মৃত্তিকা পানির পরিমাণ কমে যায় তখন গাছের পাতার রং বদলে যেতে পারে (যেমন- সবুজ থেকে হলুদ বর্ণ ধারণ), পাতা কুঁকড়িয়ে যেতে পারে । এ ছাড়াও গাছের বৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে। কোন উদ্ভিদের এ জাতীয় উপসর্গ সেচের আবশ্যকতা নির্দেশ করে । তবে এই পদ্ধতির সমস্যা এই যে, এ সমস্ত উপসর্গ দেখা দেয়ার বেশ আগেই গাছ অতিরিক্ত পানি পীড়নের শিকার হয়, ফলে গাছের যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে যায় এবং ফলন কমে যায় ।
গ) আবহাওয়া সম্পর্কিত পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে আবহাওয়ার বিভিন্ন দিক যেমন- বৃষ্টিপাত, সোলার রেডিয়েশন, তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, বাষ্পীভবন ইত্যাদি মাপা হয়। সেই সাথে বিভিন্ন গাণিতিক সমীকরণ নির্ণয় করা হয়। বাষ্পীয় প্রস্বেদন, বৃষ্টিপাত, অনুপ্রবেশ, চুয়ানোসহ অন্যান অপচয় ইত্যাদির ভিত্তিতে সেচের আবশ্যকতা ও সময় নির্ধারণ করা যায়।
সেচের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলোর বর্ণনা
জমিতে সেচের পানি বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করা যায়। ফসলের পানির প্রয়োজনীয়তা, পানির উৎস ও প্রাপ্যতা, পানির গুণাগুণ, মাটির প্রকার, জমির অবস্থান, চাষাবাদের ধরন ইত্যাদির ভিত্তিতে সেচের পদ্ধতি নির্বাচন করা হয় । আধুনিক সেচ পদতিকে ৪ ভাগে ভাগ করা যায় যথা-
১। ভূ-উপরিস্থ (Surface)
২। ভূ-মধ্যস্থ (Sub-surface)
৩। প্রিংকলার (Sprinkler)
৪ । ট্রিকল (Trickle)
১ । ভূ-উপরিস্থ সেচ পদ্ধতি (Surface irrigation system) এ পদ্ধতিতে পানি সরাসরি জমিতে দেয়া হয় ও সেচের পানি জমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এক্ষেত্রে জমিতে কয়েক সে:মি: পানি দিয়ে পরীবিত করা হয় । পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জমিকে প্রথমে মসৃণ এবং পরে জমিতে বর্ডার (পাড় বা কিনার) ফারো (লাঙলের ফলার গভীর দাগ), করোগেশন (ঢেউ খেলানো আকৃতি) ইত্যাদি তৈরি করা হয় । ভূ-পরিস্থ সেচ পদ্ধতিকে নিম্নলিখিত ৩ ভাগে ভাগ করা যায় ।
১ । অনিয়ন্ত্রিত পাবন পদ্ধতি (Uncontrolled flooding)
২ । নিয়ন্ত্রিত পাবন পদ্ধতি (Controlled flooding)। এ পদ্ধতি আবার ৩ প্রকার । যেমন-
ক) বর্ডার স্ট্রিপ (Border Strip )
খ) চেক পাবন (Check flooding)
গ) বেসিন (Basin)
৩ । ফারো পদ্ধতি (Furrow Method)। এ পদ্ধতি আবার ২ প্রকার । যেমন-
ক) ফারো (Furrow)
খ) করোগেশন (Corrugation )
১। অনিয়ন্ত্রিত পাবেন পদ্ধতি (Uncontrolled flooding) যখন নালা থেকে পানি কোন রকম বাধ অথবা তাইক অথবা অন্য কোন রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই জমিতে দেয়া হয় তখন তাকে অনিয়ন্ত্রিত পরাবান পদ্ধতি বলে । যেখানে অত্যন্ত সস্তায় প্রচুর পরিমাণে সেচের পানি পাওয়া যায় সেখানে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় ।
সুবিধা
অসুবিধা
২। নিয়ন্ত্রিত পরাবন পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে মুক্ত পাবনের পানিকে নিয়ন্ত্রণ বা বাধ দিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রবাহিত করা হয় ।
ক) বর্ডার স্ট্রিপ পদ্ধতি (Border strip )
এ পদ্ধতিতে মাঠকে অনেকগুলো খণ্ড বা ভাগে বিভক্ত করা হয় । এই খণ্ড গুলো সাধারণত ১০-২০ মি: প্রশস্ত ও ১০০-৪০০ মিটার লম্বা হয় । একটি খণ্ড থেকে অন্য খণ্ড নিচু বাঁধ বা ডাইক দ্বারা বিচ্ছিন্ন করা হয় । সরবরাহ নালা থেকে পানি এই খণ্ডসমূহে সরবরাহ করা হয় । পানি নিচের দিকে প্রবাহিত যে সমস্ত খণ্ডের জমিকেই ভিজিয়ে দেয় । প্রতিটি খন্ডে আলাদাভাবে সেচের পানি দেয়া হয় । সব ধরনের মৃত্তিকাতেই এই পদ্ধতিতে সেচ দেয়া যায় ।
খ. চেক পাবন পদ্ধতি (Check Flooding)
এ পদ্ধতিতে চারদিকে নিচু বাঁধ দ্বারা ঘেরা তুলনামূলক সমতল জমিতে বেশি পানি দেয়া হয়। অভ্যন্ত পরিশোষক মৃত্তিকা ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বেশি উপযাগী। এছাড়াও ভারি মৃত্তিকা যেখানে পানি হার কম সেখানেও এ পদ্ধতি কার্যকর । বতুত এই পদ্ধতি বর্ষার স্ট্রিপ পদ্ধতির একটি রূপান্তর।
গ) বেসিন পদ্ধতি
নিচু বাধ দ্বারা পরিবেষ্টিত সমতল জমিতে দ্রুত পানি দেয়া হয় এবং জমি শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত পানি ধরে রাখা হয় । ধান চাষের জন্য এ পদ্ধতি বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও ফল বাগান সেচ প্রদানের জন্য এ পদ্ধতি বিশেষ উপযোগী । একটি বেসিনের আওতায় ১ থেকে ৫ অথবা বেশি পরিমাণ সেচ দেয়া হয়।
সুবিধা
অসুবিধা
৩ । ফারো পদ্ধতি ফারো পদ্ধতি
দু'ধরনের যথা ফারো ও করোগেশন
ক) ফারো: ফারো পদ্ধতিতে শস্য/গাছের সারির মধ্যবর্তী ফারো (ছোট নালা) তে পানি সরবরাহ করা হয় । নালা গুলো সাধারণত প্রায় সমান্নেত ভূমি অথবা জমির ঢাল অনুযায়ী করা হয় । যে সমস্ত শস্য সারিবদ্ধ ভাবে চাষ করা হয় তাদের জন্য এ পদ্ধতি বিশেষ উপযোগী ।
খ) করোগেশন:
এটি ফারো পদ্ধতিরই একটি রূপান্তরিত অবস্থা । এ পদ্ধতিতে পানি ছোট নালায় দেয়া হয় এবং এই নালা গুলো সমস্ত মাঠ জুড়ে নির্মাণ করা হয় । পানি এই নালার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং চুবিয়ে দুই নালার মধ্যবর্তী এলাকাতে সেচ প্রদান করে ।
সুবিধা
অসুবিধা
২। -ভু মধ্যস্থ সেচ পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে মাটির বুনট এবং ফসলের শিকড়ের গভীরতার ভিত্তিতে ভূ-পৃষ্ঠের নিচে পানি প্রবাহিত করা হয় । ক্রিয়ার পানি শিকড় অঞ্চলে পৌছায়। গভীর নালা, মাটিতে প্রোধিত সিমেন্ট বা ধাতু নির্মিত ছিদ্রযুক্ত পাইপ, টাইল ড্রেন ইত্যাদির মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠের নিচে গাছের শিকড় অঞ্চলে পানি সরবরাহ করা হয়। অর্থাৎ এ পদ্ধতিতে ভূ অভ্যন্তরে এমন একটি কৃত্রিম পানির ভল তৈরি করা হয় যেখানে গাছ প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করতে পারে।
সুবিধা
অসুবিধা
৩। স্প্রিংকলার / ছিটানো পদ্ধতি/শিঞ্চন পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে পানি পাইপ ও স্প্রিংকলার নান এর মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং তা বৃষ্টির মতই মাটিতে পড়ে। এ পদ্ধতি প্রায় সব রকম ফসল ও মৃত্তিকার জন্যই উপযোগী ।
সুবিধা
অসুবিধা
৪। ট্রিকল বা ড্রিপ পদ্ধতি এটি ড্রিপ পদ্ধতি হিসেবেও পরিচিত। এ পদ্ধতিতে ছোট ব্যাসযুক্ত পাইপের একটি বিস্তারিত নেটওয়ার্ক থাকে। যা দ্বারা পানি সরাসরি গাছের গোড়ায় ফোটায় ফোটায় দেয়া হয়। এই পদ্ধতি ফল বাগান ও গ্রিন হাউসের জন্য বিশেষ উপযোগী ।
সুবিধা
অসুবিধা
গড় এলাকায় সেচ দেওয়া সুবিধাজনক নয়।
স্থাপন বেশ ঝামেলাপূর্ণ ও ব্যয় বহুল
পানির নল ও পানি নিঃ সরক প্রায়ই বন্ধ হতে পারে
খুবই পরিষ্কার পানির দরকার
পানির প্রবাহ অবিরাম পর্যবেক্ষণ করতে হয়
নিষ্কাশনের বিভিন্ন পদ্ধতি
নিষ্কাশন নালা বা নর্দমার মাধ্যমে ফসলের শিকড় অঞ্চল থেকে অপ্রয়াজনীয় বা অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়াকে নিষ্কাশন বলে । নিষ্কাশন নালা প্রধানত দুই ধরনের হয় প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম কার্য পদ্ধতি অনুসারে নিষ্কাশন নালা তিন প্রকার । যথা-
(১) ভূ-পৃষ্ঠস্থ নিষ্কাশন ব্যবস্থা (Surface)
(২) ভূ-নিম্নস্থ নিষ্কাশন নালা ( Sub - Surface or tile)।
৩) সম্মিলিত ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূ-নিম্নস্থ নিষ্কাশন নালা (Combinaton of surface and sub surface drains )
(১) ভূ-পৃষ্ঠস্থ নিষ্কাশন নালা
যে সমতল জমিতে উপরিতরের গভীরতা কম এবং ভূ-পৃষ্ঠের অল্প নিচেই অপ্রবেশ্য তর যেমন-লাঙল তল, শক্ততল বা এটেল মাটির স্তর রয়েছে সে সব জমির জন্য ভূ-পৃষ্ঠস্থ নিষ্কাশন নালা উপযোগী ।
ভূ- পৃষ্ঠস্থ নিষ্কাশন নালা তিন রকমের যেমন—
ক) স্টর্ম নিষ্কাশন ব্যবস্থা বা গভীর নালা ব্যবস্থা
খ) চুয়ানো নিষ্কাশন ব্যবস্থা
গ) সম্মিলিত স্টর্ম ও চুয়ানো নিষ্কাশন ব্যবস্থা
ক) স্টর্ম বা গভীর নিষ্কাশন নালা:
এ নালা সাধারণত অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি নির্দিষ্ট সময়ে বের করে দেওয়ার জন্য গভীর করে তৈরি করা হয় ।
(খ) চুয়ানো নিষ্কাশন নালা ( Seepage drain): সেচ নালার বা খালের পানি পাশের জমির চাইতে উঁচু দিয়ে প্রবাহিত হলে পাড় চুইয়ে জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে । চুয়ানো পানি নিষ্কাশনের জন্য সেচ খালের পাড়ের পাশেই চুয়ানো খাল খনন করা হয় । খাল গভীর করে খনন করতে হয় । চুয়ানো পানি জমা হলে এখান দিয়ে নিষ্কাশত হয় ।
(গ) সম্মিলিত স্টর্ম ও চুয়ানো নিষ্কাশন নালা: এ নালা প্রথমে চওড়া ও অগভীর করে তৈরি করে মাঝখান দিয়ে কম চওড়া করে অগভীর নালা করা হয় । এতে বৃষ্টির পানি এবং চুইয়ে আসা পানি উভয়ই বের হতে পারে ।
ভূ-পৃষ্ঠ নিষ্কাশন নালা ব্যবস্থার প্রকার
পাঁচ ধরনের ভূ-পৃষ্ঠস্থ নিষ্কাশন নালা ব্যবস্থা আছে । ফসল ক্ষেভের অবস্থা বিবেচনা করে এ পাঁচ প্রকার ব্যবস্থা থেকে দুটি বা ততোধিক ব্যবস্থা সম্মিলিত ভাবে ব্যবহার করতে হতে পারে। ব্যবস্থাগুলো নিম্নরূপ
ক) এলাপোখাড়ি নালা ব্যবস্থা (Random)
খ) প্রবাহ পথে অটিক করন নালা ব্যবস্থা (Interception)
গ) ভিন্নদিকে প্রবাহিত করান নালা ব্যবস্থা (Diversion)
ঘ) উপরিভাগ মালা ব্যবস্থা (Bedding)
ঙ) মাঠ নালা ব্যবস্থা (Field drain)
২। ভূ-মধ্যস্থ বা ভূ-নিম্নস্থ নিষ্কাশন ব্যবস্থা/টাইল (Sub Surface or file) :
এ পদ্ধতিতে মাটির অভ্যন্তর থেকে পানি টাইল অথবা মালে (এরষঃব তৎ সড়ঘর) নালার মাধ্যমে নিষ্কাশন করে ভূ-গর্ভস্থ পানির তল গাছের শিকড় অঞ্চলের নিচে নামানা হয়। এই নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে টাইল নিষ্কাশন ব্যবস্থাও বলে। এই নিষ্কাশন ব্যবস্থায় ভূ-পৃষ্ঠের নিচে নিষ্কাশন নালা স্থাপন বা তৈরি করা হয় । ভূ-গর্ভস্থ পানি তলের অবস্থান গাছের শিকড় থেকে গভীরে নামিয়ে শিকড়ের পর্যাপ্ত বৃদ্ধি ও শিকড় অঞ্চলে প্রয়োজনীয় বায়ু চলাচলের সুবিধার জন্য এ নিষ্কাশন ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকরী। বাংলাদেশে উঁচু জমিতে আবাদকৃত কসলের জন্য এই ধরনের নিষ্কাশন নালা ব্যবহার করা যেতে পারে।
বিভিন্ন উপাযািেগতা বিবেচনায় টাইল নালা পদ্ধতিতে কয়েক ধরনের বিন্যস্ততা দেখা যায় । সাধারন টাইল নিষ্কাশন পদ্ধতিসমূহ হলো -
১ । ইন্টারসেপশন (Interception)
২। র্রানডম (Random)
৩ । ডাবল মেইন (Double main )
৪ । প্যারালাল (Parallel)
৫ । গ্রিড আয়রন (Gridiron )
৬। হেরিং বানে (Herring bone)
(৩) সম্মিলিত ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূনিম্নস্থ বা ভূ মধ্যস্থ নিষ্কাশন ব্যবস্থা
এই পদ্ধতিতে উপরে বর্ণিত উভয় প্রকার নিষ্কাশন পদ্ধতি একত্রে ব্যবহার করা হয় । এ ব্যবস্থায় ভু পৃষ্ঠস্থ পানি নিষ্কাশনের নালার তলদেশের মাটির নিচে নিষ্কাশন নালা তৈরি করা যায় । এ নালার চতুর্দিকে ফিল্টার দ্রব্য ব্যবহার করা হয় ।
অতি সংক্ষিত প্রশ্ন
১। ফল গাছে সেচের প্রয়োজন হয় কেন ?
২। কৃষি কাজের জন্য অন্যতম এবং অপরিহার্য উপাদান কোনটি ?
৩ । ফল বাগানে নিকাশের প্রয়োজনীয়তা কী ?
সংক্ষিত প্রশ্ন
১। পানি সেচ বলতে কী বোঝায় লেখ ।
২। ফল বাগানে পানি নিকাশের উপকারিতা লেখ ।
৩ । ফোয়ারা বা বর্ষণ সেচ পদ্ধতির সুবিধা অসুবিধাগুলো লেখ ।
৪। সেচ ও নিকাশের পদ্ধতিগুলোর নাম লেখ ।
৫ । ফল বাগানে সেচের সুফল বর্ণনা কর ।
৬। সঠিক সময়ে সেচের পানি প্রদানের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়সমূহ কি কি ?
রচনামূলক প্রশ্ন
১ । সেচের প্রধান প্রধান পদ্ধতিগুলোর নামসহ যে কোন একটি পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা লেখ ।
২। পানি নিষ্কাশনের উদ্দেশ্য এবং সুবিধা অসুবিধা লেখ।
৩ । বাগানে সেচের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণের বিষয়াবলি বর্ণনা কর ।
৪ । ফল বাগানে সেচ ও নিষ্কাশনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর ।
৫ । ফল গাছে পানি সেচের সময় ও পরিমাণ কিভাবে নির্ধারণ করা যায় লেখ ।
Read more